ঢাকাপ্রতিদিন স্বাস্থ্য ডেস্ক : স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো ও চিকিৎসকদের পেশাদারিত্বে মানোন্নয়নের ফলে
খুলনার সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেওয়া একাধিক উদ্যোগের পর নগরীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবার এ মানোন্নয়ন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রোগীদের আশার আলো দেখাচ্ছে।
হাসপাতালগুলোতে গুণগত পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগীদের বেশি সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও নিজেদের সেবার মান উন্নত করতে রীতিমত প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
উন্নত চিকিৎসা পেশাদারিত্ব, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মিশেলে এ পরিবর্তন এসেছে,, যা ধীরে ধীরে খুলনাকে ওই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পরিণত করছে।
৫০০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (কেএমসিএইচ) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম চিকিৎসা কেন্দ্র। এ হাসপাতালে দৈনিক আড়াই হাজারেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, যা ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। তবে কয়েক বছর আগেও কেএমসিএইচতে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার রোগী চিকিৎসা নিতেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, পর্যাপ্ত পরিমাণ শয্যা না থাকায় হাসপাতালের বারান্দা ও সিঁড়িতেও রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত ভিড় সত্ত্বেও চিকিৎসকরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে জরুরি বিভাগে নিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাতেও চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে। ওয়ার্ড ও টয়লেটগুলো আগের চেয়ে আরও বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পাশেই একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণের কাজ চলছে। সুলভমূল্যে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারি হাসপাতালগুলোর ভেতরেও ফার্মেসি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এছাড়া, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি বিশেষায়িত ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এবং আধুনিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) চালুর প্রস্তুতি চলছে।
কেএমসিএইচ-এর সহকারী পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই হাসপাতাল ধীরে ধীরে পদ্মার দক্ষিণ তীরের বাসিন্দারে জন্য মডেল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিতে এখানে আসছেন। তাদের চাহিদা মতো সেবা দিতে আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পুরোপুরি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই।’
উন্নত চিকিৎসা সেবাই বিপুল সংখ্যক রোগী আসার প্রধান কারণ বলে মনে করেন তিনি।
ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালটি বর্তমানে সক্ষমতার তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি রোগীকে সেবা দিচ্ছে। তবে রোগীর সংখ্যা যতই বাড়ুক, সবাই যেন চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
এদিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা সদর হাসপাতালেও বর্তমানে দৈনিক তিন হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে যান। হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছেন ছয় শতাধিক রোগী।
অপরদিকে শহরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রদিদিন গড়ে এক হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। রোগীরা জানান, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা, ওষুধের প্রাপ্যতা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণে আগের তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মঈনুল ইসলাম গাইন। তিনি বলেন, এখানে সাত দিন ধরে আছি। একজন সিনিয়র ডাক্তার একবার দেখে গেছেন। এরপর ইন্টার্ন ডাক্তাররা সেবা দিচ্ছেন। আমি এখন অনেকটাই সুস্থ।
যশোরের জহিরুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়েকে ১২ দিন আগে ভর্তি করেছি। চিকিৎসকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সে সুস্থ হয়ে উঠছে।
খুলনা সদর হাসপাতালে পেটের ব্যথা নিয়ে ভর্তি হন মো. মিলন গাজী। তিনি বলেন, সেবার মানে চোখে পড়ার মতো উন্নত হয়েছে । ডাক্তার দেখিয়ে অনেকখানি সুস্থ্যবোধ করছি।
এছাড়াও, শহরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হিসেবে পরিচিত বেসরকারি হাসপাতাল খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও (েেকসিএমসিএইচ) রোগীর অতিরিক্ত ভিড় দেখা গেছে। সেখানে কেবিন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
কেএমসিএইচের অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এখানে ব্যক্তিগত চেম্বারও পরিচালনা করেন, যার ফলে ৪০০ টিরও বেশি কেবিন সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত থাকে।
নিরালা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সিমি চৌধুরী বলেন, আমি পিত্তথলির পাথরের ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। পরে অস্ত্রোপচার করিয়েছি। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং হাসপতালের সেবায় সন্তুষ্ট।
স্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবীরা মনে করেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে সামগ্রিক এই পরিবর্তন চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. মোসাম্মৎ মাহফুজা খাতুন জানান, চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন রোগীদের সেবায় অনেক বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, ‘রোগীরা এখন আমাদের ওপর আগের চেয়ে বেশি আস্থা রাখছেন। তাই সামান্য দেরি হলেও, চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চাচ্ছেন না।’
খুলনার বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, ‘নিয়মিত সরকারি টাস্কফোর্সের পরিদর্শন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মোবাইল টিমের অংশগ্রহণে স্বাস্থ্যসেবা খাতে তদারকি ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাড়তি চাপের মধ্যেও রোগীদের তেমন কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি।’
খুলনা নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘চিকিৎসকরা এখন সত্যিকারের জনসেবা করছেন। আগে মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটত। এখন, হাতের নাগালে মানসম্মত সেবা পাওয়ায় সেই প্রবণতার পরিবর্তিন হচ্ছে।’
ঢাকাপ্রতিদিন/এআর