আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি শাফিন আহমেদ পাড়ি জমিয়েছিলেন অনন্তের দেশে। কিন্তু তার কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো এখনো বাতাসে বাজে— ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘নীলা’, ‘পাথুরে নদীর জলে’, কিংবা ‘আজ জন্মদিন তোমার’— সব গান যেন একেকটি জীবন্ত স্মৃতিচিহ্ন, যা ভক্তদের হৃদয়ে এখনও তাজা।
২৪ জুলাই ২০২৪— শাফিনের না ফেরার দিন। সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো ভক্তদের কণ্ঠ ভার হয়ে আসে। এদিনটাই হয়ে উঠেছে এক প্রিয়শিল্পীকে হারানোর বার্ষিক শোকদিবস।
এক বছরের শূন্যতা
আজ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। বড় কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। নেই ব্যান্ড শো, নেই আলো ঝলমলে আয়োজন। আছে কেবল পরিবারের ঘরোয়া স্মরণ আর কিছু নিরব কান্না। সংগীতশিল্পীর পরিবার জানিয়েছে, তারা শাফিনকে স্মরণ করছেন তারই সৃষ্ট সুর আর গানের মাধ্যমে—নিভৃত কোনো সন্ধ্যায়, হয়তো গিটার হাতে নিয়ে।
সহশিল্পী, বন্ধু ও সংগীত অনুরাগীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার বার্তা। কেউ স্মরণ করছেন কনসার্টের স্মৃতি, কেউ আবার লিখেছেন তার ব্যক্তিত্বের কথা—শান্ত, বিনয়ী অথচ দৃঢ় একজন শিল্পী, যিনি কখনো নিজেকে সামনে না তুলে শুধুই সংগীতকে তুলে ধরতেন।
শেষ সফর: সুর থেকে শোক
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে একটি কনসার্ট করতে গিয়েছিলেন শাফিন। ৯ জুলাই একটি কনসার্টেও পারফর্ম করেন। এরপর ২০ জুলাই ভার্জিনিয়ায় আরেকটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির মাঝেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। চার দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। সুর থেমে যায় ২৪ জুলাই।
২৯ জুলাই তার মরদেহ দেশে ফিরে আসে। ঢাকায় প্রিয় শহর বনানীর কবরস্থানে ৩০ জুলাই তাকে শায়িত করা হয়। তার অন্তিমযাত্রায় ভক্ত-অনুরাগীদের দীর্ঘশ্বাসে মিশে গিয়েছিল “নীলা”র ব্যথিত সুর।

‘মাইলস’-এর নাবিক
শাফিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ‘ফ্রন্টলাইন সেনা’। জন্ম ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, এক প্রেমভরা দিনে। শৈশবেই যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার সুবাদে পাশ্চাত্য সুরের ছোঁয়া পেয়েছিলেন। দেশে ফিরে তিনি বড় ভাই হামিন আহমেদের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘মাইলস’ ব্যান্ড—যা এখনো দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সংগীতদল।
শাফিন শুধু কণ্ঠশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন একজন দক্ষ গীতিকার, সুরকার এবং বেজ গিটারিস্টও। ‘মাইলস’-এর বহু জনপ্রিয় গানের জন্ম হয়েছে তার কলমে ও সুরে। একসময় তিনি হয়ে উঠেছিলেন ব্যান্ড সংগীতের মুখপাত্র।
গানে গানে বেঁচে থাকা
শাফিন আহমেদের গান ছিল সময়ের কথা বলা এক ভাষ্য। ‘ফিরিয়ে দাও’ শুধু প্রেম-বিরহের গান নয়; এটা ছিল ফিরে পাওয়ার আকুতির প্রতীক। ‘পিয়াসী মন’ বা ‘জ্বালা জ্বালা’র মতো গানগুলো হয়ে উঠেছিল তরুণ প্রজন্মের জাগরণ সুর।
তার কণ্ঠে ছিল একটি অদ্ভুত মাদকতা—একই সঙ্গে শীতল আর আগুন। এই দ্বৈততা তাকে ভিন্ন করে তুলেছিল। এক শ্রোতা লিখেছেন—”শাফিনের গান কানে গেলে মনে হয় সময় থেমে গেছে।”
আজ জন্মদিন তোমার…
আজ শাফিনের মৃত্যুদিন। অথচ তার গান বলে, ‘আজ জন্মদিন তোমার…’। হয়তো এই গানেই তার প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা জানানো যায়—কারণ তিনি মৃত্যু দিয়ে থেমে যাননি, তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি গানে, প্রতিটি কনসার্টের গিটারে, ভক্তদের চোখে-মুখে।
শেষ কথা
এক বছর হয়ে গেলেও এই শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়। সংগীতাঙ্গনে অনেকেই আসেন, কিন্তু শাফিন আহমেদের মতো শিল্পী এক প্রজন্মে একবারই আসেন। তিনি গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন এমন একটি সংগীতভাণ্ডার, যা যতদিন বাংলা থাকবে, ততদিন বাজবে।
আজকের দিনে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তাকে স্মরণ করি— আমাদের শাফিন আহমেদকে, যিনি সুর হয়ে আকাশে ভেসে আছেন।







